ব্যবসায় উদ্যোক্তা কেস স্টাডি ১ -"উদ্যোক্তার হাসির পেছনে কান্না কি দেখতে পান?"

সফল উদ্যোক্তাদের সংগ্রাম আমরা কতটুকু জানি? হাসি মুখে যাকে ব্যবসায়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্যস্ত দেখি আসলেই কি তার জীবন সংগ্রামবিহীন? উদ্যোক্তা হওয়ার উপায় জানা থাকলেও সফল উদ্যোক্তা হয়ে নিজের পরিচয়টা শক্ত করার পথে বাধা বিভিন্ন রকম রকম হতে পারে। ব্যবসায় উদ্যোক্তা কেস স্টাডিতে আমরা আজ একটি গল্প শুনবো যেখানে বাধা হচ্ছে উদ্যোক্তার ভরসার একজনই। 

উদ্যোক্তা হওয়ার আগের দিকের কথা: 

সাবিনা ছিল খাবার বানানোয় পটু। কলেজ লাইফ থেকেই তার স্বপ্ন ছিল একটা রেস্টুরেন্ট দিবে। সময়ের সাথে ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় বুঝতে পারলো রেস্টুরেন্ট দেয়া মুখের কথা না! অনেক প্রস্তুতি আর যোগাড়পাতি ও সাথে সমমনা মানুষ দরকার। এদিকে স্বপ্ন তো পিছু ছাড়ে না! আর তাই, সাবিনা যা ভালো পারে, যেটা ভালোবাসার জায়গা অর্থাৎ রান্না ও পরিবেশন সেটা নিয়েই আগাতে থাকে। 

ক্লাসের ফাঁকে যখন সাবিনা নিজের বানানো ভেজিটেবল রোল ও বিভিন্ন ধরণের কাবাব নিয়ে যেত, ওর বন্ধুরা শুধু মুগ্ধই হতো আর আবদার করতো প্রতিদিন এভাবে রান্না করে আনতে! সাবিনার খারাপ লাগতো না কারণ তার পছন্দের মানুষ আতিকও ছিল তার বন্ধুদের মধ্যেই। আতিক শুরু থেকেই জানতো সাবিনার রান্নার প্রতি ভালোবাসার কথা আর বলে যেত যে সাবিনার স্বপ্ন পূরণে আতিক সবসময় সাহায্য করবে।  

উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নে পরিবর্তন: 

বেশ ঘটা করেই দু বছরের মধ্যেই সাবিনা ও আতিকের বিয়ে হয়ে গেলো। সাবিনা কখনোই চাকরি নিয়ে স্বপ্ন দেখেনি। লেখাপড়া করতে ভালো লাগতো তাই করতো আর স্বভাবে অনেকটা অন্তর্মুখী হওয়ার জন্য নিজের ইচ্ছা নিয়ে খুব সরব থাকতোনা কখনোই। আতিক মাঝারি ইনকামের একটা চাকরি পেয়ে যাওয়ায় দুজন বিয়ে করে পরিবারের সম্মতিতেই। নতুন জীবনে সাবিনা মানিয়ে নিতে সব চেষ্টা করে। ভুলেও যায় যে তার স্বপ্ন ছিল খাবার নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে কিছু করার। 

বছর খানেক পরে সাবিনার কোল আলো করে আসে তাদের সন্তান নুহা। আতিকের ইনকাম বাড়তে থাকে ও অফিস দূরে শিফট হয়ে যাওয়ায় তাকে বাসা বদল করে অফিসের কাছে যেতে হয়। শুরু হয় সাবিনার নতুন জীবন। আতিক অফিসে চলে গেলে নুহাকে নিয়েই তার সারাটা দিন চলতে থাকে। কখনো তার শশুড়বাড়ির কখনো তার নিজের বাড়ির মানুষজন এসে সঙ্গ দিয়ে যায়। বন্ধুরাও সবাই আতিকের মতোই ব্যস্ত আর তাই সাবিনার জীবনে একটা শূন্যতার উপস্থিতি যোগ হয়। নুহার বয়স যখন তিন বছর পার হয়ে যায় সাবিনার সাথে আতিকের দূরত্ব যেন বেড়ে যায় একটু করে। আতিকের ব্যস্ততার কারণে নিঃসঙ্গ সাবিনার শুধু মনে হতে থাকে এই জীবনই কি চেয়েছিলো সাবিনা?

উদ্যোক্তা জীবনের শুরু: 

একদিন ভেবে নিলো এভাবে আর না, কাছের মানুষ যখন বদলে যায় তখন কষ্ট হয় সবচে বেশি। তার মনের সেই স্বপ্ন আবারো উঁকি দেয়া শুরু করলো। এবার সাবিনার অফুরন্ত সময়। শুরু করলো সে নিজের একটি পরিচয় তৈরির কাজ। সাবিনা নিজেই একটি ফেসবুক পেজ খুলে নতুন অধ্যায় শুরু করলো। দেশীয় রান্নার মাঝে কিছুটা পরিবর্তন এনে গত কয়েক বছরে সাবিনা এখন আরো সিদ্ধহস্ত হয়ে গেছে। অনেক রান্না বান্নার কাজ সে করে ফেলতে পারে খুব দ্রুত। আর এই কাজে তার ক্লান্তিও আসে না। নিজের ছবি ও পরিচয় গোপন রেখে সাবিনা যখন তার ফেসবুক পেজ এক্টিভ করে অর্ডার পাওয়া শুরু করলো তার মনের সেই নিঃসঙ্গতা আর কিছু করতে না পারার কষ্ট দূর হয়ে গেলো এক নিমিষেই! ক্রেতারা যখন সুন্দর সুন্দর ফিডব্যাক দেয়া শুরু করলো সাবিনার মনে হলো তার স্বপ্ন পূরণে কেন সে এতদিন দেরি করলো।  

নুহাও খুব খুশি তার মায়ের মাঝে প্রাণচাঞ্চল্য দেখে। ব্যাপারটি বুঝতে আতিকের দুই সপ্তাহ সময় লাগলো। আর যখন বুঝতে পারলো যে সাবিনা উদ্যোক্তা হয়ে গেছে এবং প্রতিনিয়ত তার মোবাইল ফোনে খাবারের অর্ডার আসছে আর সাবিনা হাসিমুখে সব কিছু করে যাচ্ছে, আতিকের যেন একদমই সহ্য হচ্ছিলোনা! 

উদ্যোক্তার সংগ্রাম ও যুদ্ধ:

আতিকের কাছে কখন যে শুধু নিজের স্বপ্নপূরণটাই জরুরি হয়ে গেলো সেটা সে নিজেও বুঝলো না! এদিকে আরো তিন সপ্তাহের মাঝে সাবিনার কাস্টমার বাড়তে লাগলো লাফিয়ে লাফিয়ে! একদিন সেই খবর আতিক পেলো যখন তার জুনিয়র কলিগ বললো স্যার আপনার মিসেসের রান্না অসাধারণ! এই প্রশংসাটাকে আতিক কোনোভাবেই হজম করতে পারলোনা! কারণ তার অহংবোধে আঘাত লাগলো! তার স্ত্রীই যে কিনা তার প্রিয় বান্ধবী ছিল যার স্বপ্ন পূরণে সে কাছে থাকবে বলেছিলো এখন যখন তার অবহেলায় তার স্ত্রী একজন উদ্যোক্তা হয়ে স্বপ্ন পূরণ করে চলেছে, আতিকের মনে হতে লাগলো সে স্বাধীন স্ত্রী চায়না! সে চায় এমন স্ত্রী যে জীবনের প্রতি পদক্ষেপে স্বামীর উপর নির্ভরশীল থাকবে! 

সেদিন বাসায় এসেই নুহার সামনেই আতিক সাবিনাকে গালি দিয়ে কথা বলতে লাগলো। আর সেটা চলতেই থাকলো! সাবিনার প্রথমে মনে হলো দুঃস্বপ্ন দেখছে কোনো, কিন্তু নুহার ভয় পেয়ে যাওয়া তাকে বুঝিয়ে দিলো এই বাস্তবতা দুঃস্বপ্নর চেয়েও ভয়ঙ্কর! চিৎকার করে আতিক বলছিলো যে সাবিনা সবার কাছে আতিককে ছোট করতে চায়! যে কিনা একটা ডিপার্টমেন্ট চালায় যেখান থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা আসে সেই ডিপার্টমেন্ট হেডের স্ত্রী খাবার বিক্রি করে! সাবিনা চুপ করে রইলো, বুঝতে পারলো আতিকের পেশাগত সফলতা তাকে অন্ধ করে দিয়েছে, বিবেকহীন করে দিয়েছে আর তাই স্ত্রী যে তার বান্ধবী ছিল ও তার স্বপ্ন পূরণে সে ওয়াদা করেছিল, সেটাও ভুলে গেছে!

হটাৎ রাগের মাথায় আতিক রান্না ঘরে সাবিনার কেনা নতুন কিছু রান্নার সামগ্রী ছুড়ে ফেলে নষ্ট করে ফেললো! সাবিনার চোখের সামনে যেন তার গত এক দেড় মাসের স্বপ্নের জীবনটা টুকরা টুকরা হয়ে যেতে লাগলো। সাবিনা বুঝে গেলো এখন কিছু বলেও কিছু হবে না আর তার মাঝে প্রচন্ড অভিমান ও কষ্ট হচ্ছিলো যার কারণে সাবিনা চোখের পানি মুছে বাড়ি থেকে নুহাকে নিয়ে বের হয়ে গেলো। 

প্রতীকী ছবি - বিষয় - একজন উদ্যোক্তার না বলা অনুভূতি 
আতিক আটকালোনা কারণ আতিকের মনে হচ্ছিলো সাবিনা ফিরে আসবেই। কারণ অর্থনৈতিকভাবে যতটা স্বচ্ছলতা আতিকের কাছে সাবিনা পেয়ে অভ্যস্ত সেটা কোথাও পাবেনা। সাবিনা অনেক কথা লিখতে যেয়েও শুধু সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে তার পেজে পোস্ট দিলো একটি। নুহাকে নিয়ে সে বাসার ছাদে যেয়ে গান গাইলো শুধু মেয়েকে ভালো রাখতে আর বোঝাতে যে তার মা স্বাভাবিক আছে। এরই মাঝে সাবিনা স্থির করে নিলো সে থাকবেনা এভাবে আর নিজের বাড়িতে যেয়েও কারো করুনার ভরসায় থাকবেনা। তার একটি আশ্রয় দরকার যেখানে সে নতুন করে তার স্বপ্ন পূরণ করবে আর অতিককেও ছাড়বেনা নিজ থেকে কারণ নুহার জীবনে অনেক ছন্দপতন ঘটে যাবে। নিজের স্বপ্নপূরণে নিজের মেয়ের জীবনে কোনো কষ্ট দিতে রাজি না সাবিনা।  

উদ্যোক্তার জীবনে থেকে শিক্ষণীয়: 

সাবিনার কেস স্টাডি আমাদের যা শিখিয়ে দিচ্ছে - 

  • জীবনে স্বপ্ন গুরুত্বপূর্ণ 

  • স্বপ্ন পূরণে দেরি করতে নেই 

  • কাছের মানুষ আমাকে সাহায্য করবে এই ধারণায় থাকতে নেই 

  • স্বাধীন হতে কেউ সাহায্য করলে সেটা বোনাস 

  • সফলতা ঈর্ষার জন্ম দেয় অন্যের জীবনে

  • একজন উদ্যোক্তার জীবনের সংগ্রাম সবাই বুঝতে পারবে না 

সুতরাং, এখন থেকে আমরা বলতে পারি যে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন যেমন মানুষের থাকে ঠিক তেমনি থাকে এই উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার পেছনে সংগ্রাম। হয়তো এই সংগ্রাম সবার থাকেনা আবার হয়তো এই সংগ্রাম নিয়ে কেউ কথাও বলতে চায়না।  আমাদের উচিত মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া আর অন্যকে ও তার স্বপ্নকে তার দৃষ্টিকোন থেকেই দেখা ও বোঝার চেষ্টা করা। যখন পরিবারের কেউ সফল উদ্যোক্তা হয়ে যাবে সে একইসাথে নিজের ও পরিবারের জন্য আলাদা নাম ও পরিচিতি বয়ে আনবে।       

লেখক: আবু মো: আব্দুল্লাহ

 

Comments

Popular posts from this blog

"কেমন আছেন?" ছোট্ট যে প্রশ্নের ওজন অনেক

যে ৫ কারণে মানুষ একা ভ্রমণ করে

ধনী হওয়ার গোপন বিষয়গুলো কী? যা সাধারণ মানুষ খুব কম জানে